Monday, 7 September 2009
জেনেটিক বিজ্ঞান ও প্রতিবন্ধীতা
বর্তমান পরিবর্তনশীল নতুন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নীতি ও নৈতিকতার কিছু চরম ক্ষেত্রে সভ্যতার সঠিক অবস্থান গ্রহন। বিশেষ করে জেনেটিক প্রতিবন্ধীতার ব্যাপারে সময়ের সাথে সাথে মানুষের ধারনা ও উপলব্ধি বদলাচ্ছে। সমস্যাটি নিয়ে মানুষ নতুন করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে ভাবতে শুরু করেছে। এই সমস্যা সমাধানে অনেকে অনেক ভাবেই কাজ করে যাচ্ছে কিন্তু মুল সমস্যা হচ্ছে সমস্যাটিকে কোন দৃষ্টি ভঙ্গীতে দেখা হচ্ছে, নানা জন নানা ভাবে বিষয়টি দেখছে এবং দেখতে চাইছে। বিশেষ করে জেনেটিক বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর উন্নয়নের ফলে জেনেটিক প্রতিবন্ধীতা্ নিয়ে মানুষকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ও নৈতিকতার আলোকে জেনেটিক বিজ্ঞানের কিছু চরম ক্ষেত্রে সীমানা এখনো অমিমাংসিত। তাই সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি সমূহের বিজ্ঞান এবং নৈতিকতার কিছু চরম ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়ার সচেতন প্্রবনতা বিষয়টিকে উন্নয়নকর্মীদের জন্য আরও কঠিন ও বিভ্রান্তিকর করে তুলছে। নতুন করে জেনেটিক বিজ্ঞানের আলোয় ভীন্ন মাত্রায় বিষয়টি সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখা হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমন্বয়ে। আর প্রতিবন্ধীরা নিজেরাই বা সেটিকে কিভাবে দেখছে, জেনেটিক প্রতিবন্ধীরা যাদের চিকিৎসায় ভাল করা সম্ভব কিম্বা প্রায় ভাল করা সম্ভব। এ বিষয়ে প্রধান বিবেচনা যদি হয় জেনেটিক প্রতিবন্ধী কোন শিশু জন্মাবেনা তাহলে সেটিকে নৈতিকতা সমর্থন করে কিনা, তাছারা মানুষের ধর্মীয় ধারনা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি যাদের সচেতন প্রচেষ্টাতেই তাদেরকে আলাদা করে রাখা হয়েছে তারাই সব চেয়ে বড় সমস্যা ;কারণ মানুষ মাত্রই তার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে। তাদেরকে আমরা মানসিকভাবে আলাদা করে রেখে নিজেরাই সামাজিক সমস্যা তৈরি করছি; আবার সেই সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টাও করছি তাতে তাদের কি উপকার হল তা অস্পস্ট, কিন্তু যে বিষয় গুরুত্তপূর্ন তা হচ্ছে এই সমস্যাটিকে নিয়ে মুল দৃষ্টি কেন্দ্রীয়ভাবে হবে নাকি প্রান্তিক পর্যায়ে সে বিষয়েও ভীন্নমত আছে।
প্রতিবন্ধীতার ইস্যুটি জেনেটিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞান,সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অর্জিত জ্ঞানের উপর পূনঃনির্মিত হচ্ছে যা খুবই ইতিবাচক। জেনেটিক বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য বিজ্ঞান ও নৈতিকতা নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। নৈতিকতা একটি চলমান ধারনা মাত্র, এর কোন স্থীর বা পরম কোন মান নেই। প্রতিবন্ধীতা নিয়ে বেচে থাকার দৈনন্দিন নেতিবাচক অভীজ্ঞতাই তাদের নিজেদের সম্পর্কে আলাদা ভাবার আবহ তৈরী করে। স্বাভবিকত্বের ধারনা তাদের এই আলাদাকরনের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে দৃঢ় ও স্থায়ী করে এবং এই ধারা সমাজের সর্বত্র প্রতিক্রিয়াশীল। প্রতিবন্ধীতার প্রকৃত রুপ বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজা্ঞানের ভুমিকার পরিবর্তিত ইতিবাচক অবস্থার প্রেক্ষিতে উপলব্ধি করতে হবে। জেনেটিক বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে প্রতিবন্ধীতার সরুপই বদলে গেছে,কিন্তু জেনেটিক বিজ্ঞানের সীমানা নৈতিকতার আলোকে কিছু চরম জায়গায় অমিমাংসিত। সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষনা কিছু চরম ক্ষেত্রে যৌক্তিক ফলাফল সচেতন ভাবে এড়িয়ে যায়। প্রতিবন্ধীতা নিয়ে আমাদেও বর্তমান ভাবনা একটা ক্রান্তিকাল কাটাচ্ছে,দৃষ্টিভঙ্গিজাত কিছু মৌলিক বিভাজনের কারনে এসংক্রান্ত কর্মপ্রচেষ্টাও বিভাজিত এবং ফলাফল প্রত্যাশিত ভাবেই অপ্রত্যাশিত ও হতাশা ব্যঞ্জক। কিন্তু একটা বিষয় অমিমাংসিত থেকেই যায় যে, জেনেটিক বিজ্ঞানের ব্যবহারে ক্রমান্বয়ে প্রতিবন্ধী বিহীন একটি পৃথিবীই কি আমাদের কাম্য নাকি তাদের সমাজের বাস্তব অংশ হিসাবে তাদের অস্তিত্ব চিরকালই থাকবে আর সেভাবেই সামাজিক কাঠামো গড়ে উঠবে।আমাদের বর্তমান সামাজিক কাঠামোতে প্রতিবন্ধীতার বিষয়ে আমাদের যে রকম উপলব্ধি সেভাবেই তাকে আমরা বর্ননা করি। আবার সেভাবেই তা উপলব্ধিও করি, একই চক্রে বাধা। এবং পরিবর্তনের ধারায় প্রতিবন্ধীদের সহজাত বৈচিত্রতা আমরা এড়িয়ে যাই। প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষনের দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা আমাদের পর্যবেক্ষনের বস্তু বিষয় নয়। তারা আমাদের মুল জীবনের অংশ নয়, তারা আলাদা, আমাদের দয়া-দাক্ষিন্য ও করুনার উপর নির্ভরশীল আলাদা গোষ্ঠী।
যেহেতু প্রতিবন্ধিদের নিয়ে আমাদের সমাজের ধারণাগত বিভাজন ও বৈষম্য এই সমস্যা সৃষ্টি করেছে তাই তা দুই ভাবেই করতে হবে। আমাদের উন্নয়ন ধারণার মূল স্রোতে তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে দয়া-দাক্ষিন্যের দৃষ্টিতে নয় বরং সমঅংশীদারিত্ব এবং সমঅধিকারের ভিত্তিতে। প্রকৃত পক্ষে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে তাদের ব্যক্তিক উন্নয়নের চেয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনই বেশী দরকার, কারন প্রতিবন্ধীরা মুলত মনস্তাত্ত্বিক ভাবে আমাদের চোখে “স্বাভাবিক” নয়। প্রতিবন্ধীতার ধরন সমাজ ও ব্যক্তি বা পারিবারিক পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন,এই সমস্যাটি সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমন্বয়ে দেখতে হবে, নৈতিকতার বিষয়টি এখানে মানব অর্জিত জ্ঞানের চলমান ধারাই নির্ধারন করবে, কারন নৈতিকতার কোন স্থীর মূল্য কখনোই ছিলনা,এখনো নাই,ভবিষ্যতে থাকবে এমনটি আশা করার কোনই কারন নেই। কিন্তু আমাদের ধারনায় যে নৈতিকতাবোধ বর্তমানে কার্যকর তা সবলের ধারনাজাত, দুর্বলের অবস্থান থেকে নয়।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আমাদের ধারনা একটা ক্রান্তিকাল কাটাচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গীজাত কিছু মৌলিক বভাজনের ফলে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আমাদের যে উপলব্ধী সেভাবেই এসংক্রান্ত সকল কর্মকান্ড পরিচালিত, বিভিন্ন স্তরে তাদের আলাদাকরনের প্রচলিত ব্যবস্থায় তারা নিজেরাও নিজেদের আলাদা ভাবতে বাধ্য হয়। সমাজ ও সময় সেভাবেই আমাদের মানসিক কাঠামো তৈরী করে যা সামাজিক ও পারিবারিক পরিকাঠামো তৈরী করে। পরিবর্তিত পৃথিবীতে আমাদের অর্জিত জ্ঞান কিভাবে ব্যবহার করব তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কিভাবে আমরা তা করতে চাই।
স্বাভাবিকত্বের ধারনা মানববৈচিত্রতার অবমূল্যায়ন, পরিবর্তনের ধারায় মানব বৈচিত্রতাই আসলে প্রকৃত স্বাভাবিক। স্বাভাবিকত্বের কোন স্বাভাবিক রুপ নেই, তা স্থান,কাল ও পাত্র নির্ভর। স্বাভাবিকত্বের ধারনায় আসলে আমাদের মানসপটে প্রতিবন্ধীতার ধারনাই ফুটে ওঠে। সমাজে দূর্বলের উপর সবলের মনোজাগতিক আধিপত্যকামী শক্তির প্রাধান্যের ফলেই প্রতিবন্ধীদের সমপর্কে আমাদের মনে নেতিবাচক ধারনা তৈরী করে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
প্রিয় মিজান ভাই,
ReplyDeleteখুব ভাল হয়েছে। এ বিষয়ে আরো আরো লেখা চাই।